ঢাকা ০৮:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ঘোষনা:
স্পর্শ নিউজে আপনাকে স্বাগতম। বিশ্বব্যাপি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য এবং নিউজ সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে আপনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন whatsapp নাম্বারে০১৭১৬-৭২৯৫৭৪ অথবা ইমেইল নাম্বারে refazbiswas@gmail.com স্পর্শ নিউজ এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

যেখানে আকাশ লোভে পোড়ে, সেখানে শিশুর স্বপ্ন শুধু ছাই

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:১৪:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫ ১২ বার পড়া হয়েছে
স্পর্শ নিউজ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

যেখানে আকাশ লোভে পোড়ে, সেখানে শিশুর স্বপ্ন শুধু ছাই

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

উত্তরার আকাশে সেদিন দুপুরে সূর্য ছিল, আর নিচে ছিল শিশুরা। ইউনিফর্ম পরে তারা শ্রেণিকক্ষে, করিডরে, মাঠে। স্বপ্নের প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছিল, গণিতের সূত্র মনে রাখছিল, কবিতার ছন্দে হাসছিল। হঠাৎ করেই সেই আকাশ ছিঁড়ে নামে আগুন, বারুদের গন্ধে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায় শিক্ষা নামের পবিত্র ভূমি—মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

F-7 BGI প্রশিক্ষণ জেট—একটি যুদ্ধযান, এক সময়কার গর্ব, কিন্তু বহু আগেই যাকে বাতিলের তালিকায় রাখা হয়েছিল। অথচ সেই বিমান, যেটি মেরামতের খাতায় কোটি কোটি টাকা হজম করেছে, হঠাৎ করেই শিক্ষাঙ্গনের মাথার ওপর দিয়ে উড়ল—আর তারপর ধেয়ে এলো ধ্বংস হয়ে। ক্লাসরুম থেকে চিৎকার উঠল, শিশুরা জানালার কাচ ভেঙে পড়ে গেল নিচে, শিক্ষকের শরীরে ছড়িয়ে পড়ল পলিথিনের মতো পোড়া মাংস।

এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা এক রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, যার গায়ে আছে সেনাবাহিনীর উচ্চমহলের স্বাক্ষর, আর সরকারের নীরব সম্মতি।

এই বিমানের ওড়ার কথা ছিল না। এই যন্ত্র বাতিল ছিল। এটা ছিল বেইমান। আর এটিকে ওড়ানোর পেছনে ছিল টাকা। এবং সেই টাকার গন্ধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিমান বাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারকে যারা উপহার দিয়েছে অস্বচ্ছতা আর জবাবহীনতার নয়া সংবিধান।

F-7 সিরিজের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশে আসে ২০১৩ সালে। প্রায় এক দশক পর এই মেশিনের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়—বহুবার কারিগরি ত্রুটির কারণে বাতিলের সুপারিশ করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা Jane’s Defence Weekly এবং FlightGlobal পর্যন্ত এদের মান নিয়ে উদ্বেগ জানায়। অথচ বিমানের ওড়ার ‘অনুমোদন’ পায় ২০২৫ সালের মাঝামাঝি।

কে অনুমোদন দিল? কেন দিল? এই প্রশ্নের উত্তর জানেন বিমান বাহিনীর প্রধান শাইখ আব্দুল হান্নান—একজন ব্যক্তি যিনি গত পাঁচ বছরে বিমানের “রক্ষণাবেক্ষণ” খাতে প্রস্তাবিত ৮,৪৫০ কোটি টাকার বাজেটের প্রায় ৩,২০০ কোটি সরাসরি একাধিক “সিঙ্গাপুর–হংকং রুটে” পাচার করেছেন বলে প্রমাণসহ রিপোর্ট রয়েছে সামরিক নিরীক্ষা দপ্তরে।

যেখানে যুদ্ধবিমান মেরামতের নামে জঞ্জাল পরিষ্কার হয়, সেখানে কোটি কোটি টাকার লুটপাট। আর লুটপাটের পরিণাম? স্কুলের মাঠে পড়ে থাকে শিশুর লাশ। চক আর বই মিশে যায় রক্তে। শিক্ষকের পোড়া আঙুলে থাকে হোমওয়ার্কের শেষ লাইন: “আকাশে বিমান উড়ে…” সরকার বলছে: “তদন্ত হবে।” আমরা জানি, এ দেশে তদন্ত মানেই আলনা থেকে নামানো একটি পুরোনো রিপোর্টে নতুন তারিখ বসিয়ে দেওয়া।
সরকার জানে কে দোষী। সরকার জানে কে টাকা নিয়েছে। সরকার জানে সেই অনুমতিপত্র কার ডেস্ক থেকে সই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা চুপ। কারণ, যে কর্পোরেশন থেকে বিমান যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে, তাদের কমিশন পৌঁছেছে মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরেও।
অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, এমনকি একজন উপদেষ্টা পর্যন্ত যুক্ত এই চুক্তির লবিংয়ে।

একটা যুদ্ধবিমান কেন শিক্ষাঙ্গনের ওপর দিয়ে উড়বে? একটা নিষিদ্ধ, ঝুঁকিপূর্ণ জেট আবার কেন রিকন্ডিশন করে চালানো হলো? এই প্রশ্নগুলো আজ চাপা পড়ে গেছে ‘শোক’ আর ‘সমবেদনা’র কাঁধে ভর করে।

কিন্তু আমরা যারা লিখি, যারা দেখেছি একজন মায়ের পুড়ে যাওয়া ছেলের ব্যাগটা কাঁদতে কাঁদতে বুকে জড়িয়ে রাখা, তারা জানি—এই লাশগুলোর প্রতিটা ছিল রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, আর প্রতিটা খুন হয়েছে একটা কমিশনের ফাইলে সই হয়ে।

আজ কেউ জবাব চায় না। কারণ আজ রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে গেছে ক্ষমতা। এবং সেই ক্ষমতার ব্যাকরণে শিশুদের মৃত্যু শুধু “প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা”—যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করাই যথেষ্ট। কিন্তু না, তা যথেষ্ট নয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। এই লোভের সমাধি চাই। আর যদি না হয়, তাহলে ধরে নেওয়া উচিত— এই রাষ্ট্র এখন আর জনসাধারণের নয়। এই রাষ্ট্র এখন হেলিকপ্টারে ভাসা লুটেরাদের।

“আজ যদি প্রশ্ন না করি, কাল নিজ সন্তানকে হারিয়ে কাঁদলেও কেউ পাশে দাঁড়াবে না।আকাশ থেকে আগুন আরও নামবে— আর আমরা পোড়ার গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যাব।”

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

যেখানে আকাশ লোভে পোড়ে, সেখানে শিশুর স্বপ্ন শুধু ছাই

আপডেট সময় : ০৯:১৪:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

যেখানে আকাশ লোভে পোড়ে, সেখানে শিশুর স্বপ্ন শুধু ছাই

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

উত্তরার আকাশে সেদিন দুপুরে সূর্য ছিল, আর নিচে ছিল শিশুরা। ইউনিফর্ম পরে তারা শ্রেণিকক্ষে, করিডরে, মাঠে। স্বপ্নের প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছিল, গণিতের সূত্র মনে রাখছিল, কবিতার ছন্দে হাসছিল। হঠাৎ করেই সেই আকাশ ছিঁড়ে নামে আগুন, বারুদের গন্ধে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায় শিক্ষা নামের পবিত্র ভূমি—মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

F-7 BGI প্রশিক্ষণ জেট—একটি যুদ্ধযান, এক সময়কার গর্ব, কিন্তু বহু আগেই যাকে বাতিলের তালিকায় রাখা হয়েছিল। অথচ সেই বিমান, যেটি মেরামতের খাতায় কোটি কোটি টাকা হজম করেছে, হঠাৎ করেই শিক্ষাঙ্গনের মাথার ওপর দিয়ে উড়ল—আর তারপর ধেয়ে এলো ধ্বংস হয়ে। ক্লাসরুম থেকে চিৎকার উঠল, শিশুরা জানালার কাচ ভেঙে পড়ে গেল নিচে, শিক্ষকের শরীরে ছড়িয়ে পড়ল পলিথিনের মতো পোড়া মাংস।

এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা এক রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, যার গায়ে আছে সেনাবাহিনীর উচ্চমহলের স্বাক্ষর, আর সরকারের নীরব সম্মতি।

এই বিমানের ওড়ার কথা ছিল না। এই যন্ত্র বাতিল ছিল। এটা ছিল বেইমান। আর এটিকে ওড়ানোর পেছনে ছিল টাকা। এবং সেই টাকার গন্ধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিমান বাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারকে যারা উপহার দিয়েছে অস্বচ্ছতা আর জবাবহীনতার নয়া সংবিধান।

F-7 সিরিজের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশে আসে ২০১৩ সালে। প্রায় এক দশক পর এই মেশিনের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়—বহুবার কারিগরি ত্রুটির কারণে বাতিলের সুপারিশ করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা Jane’s Defence Weekly এবং FlightGlobal পর্যন্ত এদের মান নিয়ে উদ্বেগ জানায়। অথচ বিমানের ওড়ার ‘অনুমোদন’ পায় ২০২৫ সালের মাঝামাঝি।

কে অনুমোদন দিল? কেন দিল? এই প্রশ্নের উত্তর জানেন বিমান বাহিনীর প্রধান শাইখ আব্দুল হান্নান—একজন ব্যক্তি যিনি গত পাঁচ বছরে বিমানের “রক্ষণাবেক্ষণ” খাতে প্রস্তাবিত ৮,৪৫০ কোটি টাকার বাজেটের প্রায় ৩,২০০ কোটি সরাসরি একাধিক “সিঙ্গাপুর–হংকং রুটে” পাচার করেছেন বলে প্রমাণসহ রিপোর্ট রয়েছে সামরিক নিরীক্ষা দপ্তরে।

যেখানে যুদ্ধবিমান মেরামতের নামে জঞ্জাল পরিষ্কার হয়, সেখানে কোটি কোটি টাকার লুটপাট। আর লুটপাটের পরিণাম? স্কুলের মাঠে পড়ে থাকে শিশুর লাশ। চক আর বই মিশে যায় রক্তে। শিক্ষকের পোড়া আঙুলে থাকে হোমওয়ার্কের শেষ লাইন: “আকাশে বিমান উড়ে…” সরকার বলছে: “তদন্ত হবে।” আমরা জানি, এ দেশে তদন্ত মানেই আলনা থেকে নামানো একটি পুরোনো রিপোর্টে নতুন তারিখ বসিয়ে দেওয়া।
সরকার জানে কে দোষী। সরকার জানে কে টাকা নিয়েছে। সরকার জানে সেই অনুমতিপত্র কার ডেস্ক থেকে সই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা চুপ। কারণ, যে কর্পোরেশন থেকে বিমান যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে, তাদের কমিশন পৌঁছেছে মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরেও।
অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, এমনকি একজন উপদেষ্টা পর্যন্ত যুক্ত এই চুক্তির লবিংয়ে।

একটা যুদ্ধবিমান কেন শিক্ষাঙ্গনের ওপর দিয়ে উড়বে? একটা নিষিদ্ধ, ঝুঁকিপূর্ণ জেট আবার কেন রিকন্ডিশন করে চালানো হলো? এই প্রশ্নগুলো আজ চাপা পড়ে গেছে ‘শোক’ আর ‘সমবেদনা’র কাঁধে ভর করে।

কিন্তু আমরা যারা লিখি, যারা দেখেছি একজন মায়ের পুড়ে যাওয়া ছেলের ব্যাগটা কাঁদতে কাঁদতে বুকে জড়িয়ে রাখা, তারা জানি—এই লাশগুলোর প্রতিটা ছিল রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, আর প্রতিটা খুন হয়েছে একটা কমিশনের ফাইলে সই হয়ে।

আজ কেউ জবাব চায় না। কারণ আজ রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে গেছে ক্ষমতা। এবং সেই ক্ষমতার ব্যাকরণে শিশুদের মৃত্যু শুধু “প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা”—যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করাই যথেষ্ট। কিন্তু না, তা যথেষ্ট নয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। এই লোভের সমাধি চাই। আর যদি না হয়, তাহলে ধরে নেওয়া উচিত— এই রাষ্ট্র এখন আর জনসাধারণের নয়। এই রাষ্ট্র এখন হেলিকপ্টারে ভাসা লুটেরাদের।

“আজ যদি প্রশ্ন না করি, কাল নিজ সন্তানকে হারিয়ে কাঁদলেও কেউ পাশে দাঁড়াবে না।আকাশ থেকে আগুন আরও নামবে— আর আমরা পোড়ার গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যাব।”