ঢাকা ০১:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ঘোষনা:
স্পর্শ নিউজে আপনাকে স্বাগতম। বিশ্বব্যাপি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য এবং নিউজ সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে আপনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন whatsapp নাম্বারে০১৭১৬-৭২৯৫৭৪ অথবা ইমেইল নাম্বারে refazbiswas@gmail.com স্পর্শ নিউজ এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

সন্তানকে বাঁচাতে কিডনি বিক্রির ঘোষণা শিক্ষকের

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৫:২৬:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫ ১ বার পড়া হয়েছে
স্পর্শ নিউজ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সন্তানকে বাঁচাতে কিডনি বিক্রির ঘোষণা শিক্ষকের

মো.সাইফুল ইসলাম:নীলফামারী প্রতিনিধি।

জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা তখনই সামনে আসে, যখন একজন বাবা নিজের অঙ্গ বিক্রির কথা ভাবেন শুধুমাত্র সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন নীলফামারী সদর উপজেলার চড়চড়াবাড়ি এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষক মনিরুজ্জামান লিটন। নিজের ছেলেকে ক্যান্সারের করাল থাবা থেকে বাঁচাতে তিনি এখন নিজের কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মনিরুজ্জামান লিটন পেশায় একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। প্রায় দুই দশকের শিক্ষকতা জীবনে তিনি শত শত শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন। অথচ আজ তিনি নিজেই এক অসহায় অন্ধকারে ডুবে আছেন—একজন বাবার সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া সংগ্রামে।

তার বড় ছেলে রাফিউজ্জামান রাসিক (১২), স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০২০ সালে তার শরীরে ধরা পড়ে এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, এক বিরল রক্তজনিত ক্যান্সার। শুরু থেকেই রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলছে রাসিকের চিকিৎসা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (Bone Marrow Transplant) ছাড়া স্থায়ীভাবে সুস্থ হওয়ার কোনো পথ নেই। চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ২৫ থেকে ২৬ লাখ টাকা।

একজন সাধারণ শিক্ষকের পক্ষে এত বিপুল অর্থ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। গত পাঁচ বছরে লিটন নিজের সঞ্চয়, সহায়-সম্পদ, এমনকি আত্মীয়-স্বজন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সহায়তায় চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। বর্তমানে রাসিকের ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যয় দৈনিক প্রায় দুই হাজার টাকা—অর্থাৎ মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা।

অসহায় এই বাবা সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক মর্মস্পর্শী পোস্ট দেন— “আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য আমি আমার কিডনি বিক্রি করতে চাই। দয়া করে কেউ সাহায্য করুন।”

এই সংক্ষিপ্ত পোস্টটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে সহানুভূতি, ক্ষোভ ও করুণার ঢেউ বয়ে যায়। কেউ সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন, কেউ আবার শুধু প্রার্থনা করছেন।

গণমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে চোখ ভেজা কণ্ঠে মনিরুজ্জামান লিটন বলেন, “আমি ২০২০ সাল থেকে আমার ছেলের জন্য যুদ্ধ করছি। যা ছিল, সব বিক্রি করেছি। এখন শুধু আমার বাড়িটা আছে। যদি কেউ আমার কিডনি কিনে নেয়, তাহলে সেই টাকায় ছেলেকে বাঁচাতে পারব। আমি না থাকলেও সমস্যা নেই—আমার ছেলে বাঁচুক।”

তার স্ত্রী রিপা বেগম বলেন, “আমরা সবাই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য লড়ছি। আমার স্বামী বলেছেন, তিনি না থাকলে যেন আমি ছেলেদের দেখভাল করি। আমাদের একটাই স্বপ্ন—রাসিকের বাঁচা।”

রাসিকের দাদি মেরিনা বেগম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “করোনার সময় জ্বরে আক্রান্ত হলে রংপুরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতে জানা যায় ওর ক্যান্সার। তখন থেকেই লড়াই শুরু। আল্লাহ যদি হায়াত দেন, আমার নাতি ঠিক হয়ে যাবে।”

স্থানীয় বাসিন্দা আফজাল হোসেন জানান, “লিটন স্যার নিজের জমি-বাড়ি প্রায় বিক্রি করে দিয়েছেন ছেলের চিকিৎসায়। এখন কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনে আমরা সবাই মর্মাহত। একজন বাবা সন্তানের জন্য এমন ত্যাগ করতে পারেন, এটা ভাবাই যায় না।”

এদিকে শিক্ষক লিটনের সহকর্মী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে এখন রাসিকের চিকিৎসায় একটি সহযোগিতা তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, সরকার, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে হয়তো রাসিককে বাঁচানো সম্ভব হবে।

অসুস্থ রাসিক নিজেও জানায় তার স্বপ্নের কথা—“আমার বাবা আমার জন্য সব কিছু শেষ করে দিয়েছেন। আমি যদি সুস্থ হই, আমি ডাক্তার হতে চাই। গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেব, কারণ আমি জানি টাকার অভাবে চিকিৎসা না পাওয়ার কষ্টটা কেমন।”

স্থানীয় ইউপি সদস্য রশিদুল ইসলাম বলেন, “পুরো এলাকায় এখন একটাই আলোচনা—লিটন স্যার তাঁর ছেলের জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করতে চান। সন্তানের জন্য এমন আত্মত্যাগ খুব বিরল। আমরা চাই, সমাজের বিত্তবান ও সরকার এই বাবার পাশে দাঁড়াক।”

একজন শিক্ষক, যিনি সারাজীবন মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, আজ নিজের শরীরের অঙ্গ বিক্রি করে একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন—এ যেন মানবতার সবচেয়ে করুণ, তবুও সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক এক দৃষ্টান্ত।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

সন্তানকে বাঁচাতে কিডনি বিক্রির ঘোষণা শিক্ষকের

আপডেট সময় : ০৫:২৬:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

সন্তানকে বাঁচাতে কিডনি বিক্রির ঘোষণা শিক্ষকের

মো.সাইফুল ইসলাম:নীলফামারী প্রতিনিধি।

জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা তখনই সামনে আসে, যখন একজন বাবা নিজের অঙ্গ বিক্রির কথা ভাবেন শুধুমাত্র সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন নীলফামারী সদর উপজেলার চড়চড়াবাড়ি এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষক মনিরুজ্জামান লিটন। নিজের ছেলেকে ক্যান্সারের করাল থাবা থেকে বাঁচাতে তিনি এখন নিজের কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মনিরুজ্জামান লিটন পেশায় একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। প্রায় দুই দশকের শিক্ষকতা জীবনে তিনি শত শত শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন। অথচ আজ তিনি নিজেই এক অসহায় অন্ধকারে ডুবে আছেন—একজন বাবার সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া সংগ্রামে।

তার বড় ছেলে রাফিউজ্জামান রাসিক (১২), স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০২০ সালে তার শরীরে ধরা পড়ে এপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, এক বিরল রক্তজনিত ক্যান্সার। শুরু থেকেই রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলছে রাসিকের চিকিৎসা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (Bone Marrow Transplant) ছাড়া স্থায়ীভাবে সুস্থ হওয়ার কোনো পথ নেই। চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ২৫ থেকে ২৬ লাখ টাকা।

একজন সাধারণ শিক্ষকের পক্ষে এত বিপুল অর্থ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। গত পাঁচ বছরে লিটন নিজের সঞ্চয়, সহায়-সম্পদ, এমনকি আত্মীয়-স্বজন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সহায়তায় চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। বর্তমানে রাসিকের ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যয় দৈনিক প্রায় দুই হাজার টাকা—অর্থাৎ মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা।

অসহায় এই বাবা সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক মর্মস্পর্শী পোস্ট দেন— “আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য আমি আমার কিডনি বিক্রি করতে চাই। দয়া করে কেউ সাহায্য করুন।”

এই সংক্ষিপ্ত পোস্টটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে সহানুভূতি, ক্ষোভ ও করুণার ঢেউ বয়ে যায়। কেউ সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন, কেউ আবার শুধু প্রার্থনা করছেন।

গণমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে চোখ ভেজা কণ্ঠে মনিরুজ্জামান লিটন বলেন, “আমি ২০২০ সাল থেকে আমার ছেলের জন্য যুদ্ধ করছি। যা ছিল, সব বিক্রি করেছি। এখন শুধু আমার বাড়িটা আছে। যদি কেউ আমার কিডনি কিনে নেয়, তাহলে সেই টাকায় ছেলেকে বাঁচাতে পারব। আমি না থাকলেও সমস্যা নেই—আমার ছেলে বাঁচুক।”

তার স্ত্রী রিপা বেগম বলেন, “আমরা সবাই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য লড়ছি। আমার স্বামী বলেছেন, তিনি না থাকলে যেন আমি ছেলেদের দেখভাল করি। আমাদের একটাই স্বপ্ন—রাসিকের বাঁচা।”

রাসিকের দাদি মেরিনা বেগম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “করোনার সময় জ্বরে আক্রান্ত হলে রংপুরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতে জানা যায় ওর ক্যান্সার। তখন থেকেই লড়াই শুরু। আল্লাহ যদি হায়াত দেন, আমার নাতি ঠিক হয়ে যাবে।”

স্থানীয় বাসিন্দা আফজাল হোসেন জানান, “লিটন স্যার নিজের জমি-বাড়ি প্রায় বিক্রি করে দিয়েছেন ছেলের চিকিৎসায়। এখন কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনে আমরা সবাই মর্মাহত। একজন বাবা সন্তানের জন্য এমন ত্যাগ করতে পারেন, এটা ভাবাই যায় না।”

এদিকে শিক্ষক লিটনের সহকর্মী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে এখন রাসিকের চিকিৎসায় একটি সহযোগিতা তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, সরকার, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে হয়তো রাসিককে বাঁচানো সম্ভব হবে।

অসুস্থ রাসিক নিজেও জানায় তার স্বপ্নের কথা—“আমার বাবা আমার জন্য সব কিছু শেষ করে দিয়েছেন। আমি যদি সুস্থ হই, আমি ডাক্তার হতে চাই। গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেব, কারণ আমি জানি টাকার অভাবে চিকিৎসা না পাওয়ার কষ্টটা কেমন।”

স্থানীয় ইউপি সদস্য রশিদুল ইসলাম বলেন, “পুরো এলাকায় এখন একটাই আলোচনা—লিটন স্যার তাঁর ছেলের জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করতে চান। সন্তানের জন্য এমন আত্মত্যাগ খুব বিরল। আমরা চাই, সমাজের বিত্তবান ও সরকার এই বাবার পাশে দাঁড়াক।”

একজন শিক্ষক, যিনি সারাজীবন মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, আজ নিজের শরীরের অঙ্গ বিক্রি করে একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন—এ যেন মানবতার সবচেয়ে করুণ, তবুও সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক এক দৃষ্টান্ত।